বাণী ইয়াসমিন হাসি : একটি প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদনের সময়ই প্রকল্পটি কবে কোথায় কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, অর্থ কোথা থেকে আসবে তা যাচাই-বাছাই করেই চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সর্বোচ্চ ফোরামের বৈঠকে তা অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় নানা ধরনের অসাধু কর্মকাণ্ড। বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের যোগসাজশে নানা অজুহাত তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। প্রকল্পের এক পর্যায়ে এসে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়। আর এই বিলম্বের অজুহাতে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়ানো হয়। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে এটা অবশ্যই এক ধরনের সরকারি অর্থের অপচয় এবং অপব্যবহার।
গতকাল রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উড়ালসড়কের গার্ডারের চাপায় ৫ জন নিহতের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা এবং দুর্নীতির বিষয়টি। আমার আজকের লেখায় বিআরটির দুইটি প্রকল্প নিয়ে কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করবো।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ লেনের মাধ্যমে বাস চলাচলের জন্য বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে। নির্মাণকাজ শুরুর পর এ পর্যন্ত বিআরটির উড়ালপথ তৈরির গার্ডার ধসে চারটি বড়ো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার রাজধানীর উত্তরার জসিমউদ্দীন রোড এলাকায় গার্ডার তোলার সময় তা একটি গাড়ির ওপর পড়ে যায়। এ ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর আগে গত ১৫ জুলাই গাজীপুর শহরে গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। গত বছর ১৪ মার্চ বিমানবন্দর এলাকায় এবং আবদুল্লাহপুরে একই দিনে দুবার গার্ডারধসের ঘটনা ঘটে। এতে নির্মাণকাজে যুক্ত ছয়জন আহত হন। তাদের মধ্যে তিনজন চীনের নাগরিক ছিলেন।
প্রকল্প–সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১২ সালে নেওয়া বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে উড়ালপথ ও সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব পালন করছে তিনটি চীনা কোম্পানি। এগুলো হচ্ছে চায়না গেজহুবা গ্রুপ, জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। আর গাজীপুরে ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে ছিল দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি। এদের কাজ আগেই শেষ হয়েছে। তবে চীনের তিনটি কোম্পানির কাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত চারটি সংস্থা। এর মধ্যে তিনটি সংস্থা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন। সড়ক পরিবহন বিভাগ সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছে। ৫ বছরের প্রকল্প প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ চলছে। এর মধ্যে ব্যয় বেড়েছে ১০৯ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
২০১২ সালে গাজীপুর থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প শুরু হয়। সে সময় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ব্যয় দ্বিগুণ (৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ ১৪ টাকা) করা হয়। এরপর আরও দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময়সীমা করা হয়। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সর্বশেষ বলা হচ্ছে, বাকি কাজ শেষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে লেগে যাবে ২০২৩ সালের শুরু পর্যন্ত। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এডিবি, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল অ্যানভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (ডিইএফ) অর্থায়ন করছে।
এটা মাত্র দুইটি প্রকল্পের তথ্য। কেস স্টাডি করলে বাকি প্রকল্পেরও একই চিত্র বেরিয়ে আসবে। একটি বড়ো প্রকল্পে শুরুতে প্রাথমিক সমীক্ষা করতে হয়। এরপর চূড়ান্ত সমীক্ষা করে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ও নকশা হওয়ার আগেই প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন নির্মাণকাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ফলে পানি জমে যাচ্ছে। সেবা সংস্থার লাইন কীভাবে সরানো হবে, তা-ও আগে থেকে ঠিক করা হয়নি। ব্যস্ততম সড়কে নির্মাণকাজের সময় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার কোনো বিকল্প চিন্তাও করা হয়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় এবং খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ থেকে আড়াই গুণ। প্রকল্পে রয়েছে ধীরগতির কাজের নজির। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই অর্থসংকটে ভোগে। এ ছাড়া তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ জন্যই কাজের গতি কম, মান নিয়ে অসন্তোষ আছে। এমন মানহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ পায়?
গতকালের হতাহতের পর ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে মামলা হয়েছে ঠিকাদার কোম্পানি, ক্রেইন চালক এবং প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে। আমার প্রশ্ন হলো, প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কেন মামলা থেকে বাদ পড়লেন ? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রকল্প পরিচালক এরা কি দায় এড়াতে পারেন ?
লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট ও
পরিচালক, জাগরণ টিভি।
সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন